শুক্রবার, ০৩ অক্টোবর ২০২৫, ০৪:৩৯ পূর্বাহ্ন
মুফতি এনায়েতুল্লাহ:
মানবতার ধর্ম ইসলাম মায়ের মর্যাদা ও অধিকার প্রতিষ্ঠায় দৃঢ় প্রতিজ্ঞ। পবিত্র কোরআনের অন্তত পনেরো জায়গায় পিতা-মাতার প্রতি সন্তানের কর্তব্যের কথা বলা হয়েছে, দেওয়া হয়েছে মাকে সম্মানের উচ্চাসন। আর একাধিক হাদিসের সারকথা হলো, মায়ের সেবা-শুশ্রƒষা দ্বারা জান্নাতের হকদার হওয়া যায়। মায়ের সন্তুষ্টি দুনিয়ার সাফল্য ও আখিরাতের মুক্তির কারণ।
সৃষ্টিজগতের মধ্যে সর্বাধিক অনুগ্রহকারী ও দয়াবান অন্তরের অধিকারী করে সৃষ্টি করা হয়েছে মাকে। সন্তানের ওপর মায়ের যে হক, তা পুরোপুরি পরিশোধ করার মতো নয়, এটা বিনিময়যোগ্য কোনো বিষয়ও নয়। সন্তানের জন্য মায়ের এক রাতের কষ্টের বিনিময় আদায় করা যাবে না কোনোভাবেই। মায়ের সঙ্গে নম্র আচরণ, যথাসাধ্য সেবা-শুশ্রƒষা এবং কায়মনোবাক্যে তার প্রতিদানের জন্য মহান প্রভুর দরবারে দোয়া করলে মায়ের হক সামান্য আদায় হতে পারে। বলা হয়, মা সন্তানের জন্য জান্নাতের পথ করে দেন। মায়ের সন্তুষ্টিই আবার সন্তানকে জাহান্নামে পৌঁছায়। যে সন্তান মায়ের সান্নিধ্য গ্রহণের পাশাপাশি মাকে সন্তুষ্ট করতে পেরেছে, তারাই সাফল্যের সন্ধান পেয়েছে।
পবিত্র কোরআনে ইরশাদ হয়েছে, ‘আর তোমার পালনকর্তা (কতিপয়) সিদ্ধান্ত দিয়েছেন (তা এই) যে, তোমরা শুধু তারই ইবাদত করবে এবং পিতা-মাতার সঙ্গে সদ্ব্যবহার করবে। যদি তাদের মধ্যে একজন কিংবা দুজনই তোমার কাছে বৃদ্ধ বয়সে অবশ্যই পৌঁছে যায়, তাহলে (তাদের খিটখিটে ব্যবহারে বিরক্ত হয়ে) তাদের তুমি উহ্ শব্দ বলবে না এবং তাদের ধমক দেবে না। আর তাদের সঙ্গে তুমি সম্মানজনক কথা বলবে এবং তাদের জন্য দোয়ার মধ্য থেকে নম্রতার বাহু ঝুঁকিয়ে দাও। আর তাদের জন্য দোয়াস্বরূপ এ কথা বলবে, হে আমার পালনকর্তা! তাদের দুজনের ওপর ওইরূপ দয়া করো, যেরূপ তারা আমাকে ছোটবেলায় লালন-পালন করেছিলেন।’ সুরা বনি ইসরাইল : ২৩-২৪
বর্ণিত আয়াত দুটিতে মহান আল্লাহ মানুষকে ৫টি বিষয়ে নির্দেশ দিয়েছেন। ১. আল্লাহর ইবাদতের পরই পিতা-মাতার সঙ্গে সদ্ব্যবহার, ২. পিতা-মাতাকে বৃদ্ধ বয়সে পেলে তাদের খিটখিটে মেজাজের কারণে বিরক্ত না হওয়া, ৩. তাদের ধমক না দেওয়া, ৪. তাদের মানসম্মান রেখে কথা বলা এবং শক্তির গরম না দেখানো ও ৫. তাদের প্রতি দয়া করার জন্য আল্লাহর কাছে দোয়া করা।
সৃষ্টিকর্তা আল্লাহতায়ালার নেয়ামতরাজিকে যেমন কেউ গণনা করে শেষ করতে পারে না, তেমনিভাবে পিতা-মাতার অনুগ্রহ কেউ হিসাব করে শেষ করতে পারবে না। কোরআন মাজিদ তাই আমাদের বলে, প্রথমে আল্লাহর কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করতে এর পর পিতা-মাতার প্রতি কৃতজ্ঞ হতে। তবে কৃতজ্ঞতা প্রকাশের অর্থ এই নয় যে, শুধু তাদের ধন্যবাদ বলবে, বছরের এক দিন তাদের সঙ্গে কাটাবে, ভালো কিছু উপহার ও পোশাকাদি দিয়েই দায়িত্ব শেষ বলে মনে করবে। বরং দায়িত্ব হলো, তাদের আরাম-আয়েশ, সুচিকিৎসা ও মানসিক প্রশান্তির লক্ষ্যে প্রয়োজনীয় সব ব্যবস্থা গ্রহণ করা।
বলতে দ্বিধা নেই, সমাজের অনেকেই খুব ঘটা করে বছরের একটি দিনকে মা দিবস হিসেবে পালন করেন। দুর্ভাগ্যবশত অধিকাংশ ক্ষেত্রেই দেখা যায়, এ মায়েরা শেষ বয়সে অনেকটা অযতে্ন-অবহেলায় কিংবা কোনো বৃদ্ধাশ্রমে জীবন পার করছেন। এমন আচরণ ও লোকদেখানো মনোভাব কাম্য নয়। ইসলামের শিক্ষা হলো, পিতা-মাতার প্রতি এমন দৃষ্টিভঙ্গি রাখতে হবে, যা আল্লাহর প্রতি এবং পিতা-মাতার প্রতি আমাদের কৃতজ্ঞতাবোধকে প্রতিফলিত করে।
ইসলামের শুধু নিজের পিতা-মাতাকে ভালোবাসতে ও সম্মান জানানোর কথাই বলে না। বরং অন্যদের পিতা-মাতার সঙ্গেও অনুরূপ আচরণ করতে শিক্ষা দেয়। আর নবী করিম (সা.) মায়ের মর্যাদা দিতে গিয়ে বলেছেন, ‘মায়ের পায়ের নিচে সন্তানের বেহেশত।’ ইসলামের এই বুনিয়াদি শিক্ষা মুসলিমসমাজে মায়েদের একটি সম্মানজনক ও মর্যাদাপূর্ণ অবস্থান দান করেছে। পরিবারের সব সদস্যের কাছে মা তার জীবনের শেষ নিঃশ্বাস পর্যন্ত ভালোবাসা ও সম্মানের কেন্দ্র হিসেবে পরিগণিত হয়ে থাকে। ইসলামের বিধানে পিতা-মাতার জন্য ব্যয় করা সওয়াবের কাজ। ইসলাম বলে, আমরা যা কিছুই আল্লাহতায়ালার সন্তুষ্টির জন্য খরচ করি না কেন, পরিবার কিংবা সমাজের অন্যান্য লোকের আগে প্রথমে পিতা-মাতার জন্য খরচ করতে হবে। অতএব, যদি কেউ তার পরিবারের সদস্যদের ওপর ব্যয় করে কিংবা সমাজের কোনো মহৎ কাজে ব্যয় করে, কিন্তু পিতা-মাতার অধিকার সম্পর্কে বেখবর থাকে, সে আল্লাহর নির্দেশ লঙ্ঘন করে।
পিতা-মাতার জন্য অর্থ-সম্পদ রেখে যাওয়াও ইসলামের বিধান। ইসলামই একমাত্র ধর্ম, যা এমন এক সমাজব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করেছে, যাতে শুধু অধস্তনরাই উত্তরাধিকারপ্রাপ্ত হয় না; বরং ঊর্ধ্বতন পরম্পরাতেও উত্তরাধিকার বণ্টিত হয়। বিশ্বের অন্যসব সমাজব্যবস্থায় শুধু অধস্তনদের জন্য উত্তরাধিকারের আইন প্রচলিত। এ প্রসঙ্গে ইরশাদ হয়েছে, ‘তোমাদের ওপর ফরজ করা হয়েছে, যখন তোমাদের কারও মৃত্যু উপস্থিত হবে, যদি সে কোনো সম্পদ রেখে যায়, তবে পিতা-মাতা ও নিকট আত্মীয়দের জন্য ন্যায়ভিত্তিক অসিয়ত করবে। এটি মুত্তাকিদের দায়িত্ব।’ সুরা আল বাকারা : ১৮০
এক হাদিসে ইরশাদ হয়েছে, এক ব্যক্তি হজরত রাসুলুল্লাহ (সা.)-কে জিজ্ঞেস করল, সন্তানের ওপর মা-বাবার হক কী? নবী করিম (সা.) বললেন, ‘তারা উভয়েই তোমার জান্নাত অথবা জাহান্নাম।’ অর্থাৎ তাদের আনুগত্য ও সেবাযতœ জান্নাতে নিয়ে যায় এবং তাদের সঙ্গে বেয়াদবি ও তাদের অসন্তুষ্টি জাহান্নামে পৌঁছে দেয়। হজরত ছাওবান (রা.) বর্ণনা করেন, হজরত রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, দোয়া ছাড়া অন্যকিছু ভাগ্যকে বদলাতে পারে না এবং পিতা-মাতার প্রতি সদাচার ছাড়া অন্যকিছু আয়ুকে প্রলম্বিত করতে পারে না। কোনো ব্যক্তি তার পাপের কারণে তার রিজিক থেকে বঞ্চিত হয়। ইবনে মাজাহ
হাদিসে জীবন প্রলম্বিত হওয়া সম্পর্কে বিজ্ঞজনরা বলেন, এ থেকে উদ্দেশ্য জীবনে সৎকাজের পরিমাণ বৃদ্ধি পাওয়া, বছরের সংখ্যা বৃদ্ধি নয়। যে ব্যক্তি পিতা-মাতার অনুগত সে জীবনে ভালো কাজ করার যথেষ্ট সময় ও সুযোগ লাভ করবে। পক্ষান্তরে, যে ব্যক্তি পিতা-মাতার অবাধ্য হবে সে বিভিন্ন রোগ, শোক, দুঃখ বেদনা ও পেরেশানিতে আক্রান্ত হবে এবং জীবনে ভালো কাজের সুযোগ থেকে বঞ্চিত হবে।
লেখক : শিক্ষক ও ইসলামবিষয়ক গবেষক
muftianaet@gmail.com
ভয়েস/আআ